Thursday, 16 April 2020

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং মহালয়া Virendra Krishna Vadra and Mahalaya Bengali Story

0


শনি রবিবারেও রাস্তার ভিড় চোখে পড়ার মতো | রাস্তায় নির্বাক দাড়িয়ে থাকা সারি সারি গাড়ি গুলো বোধয় তার ই প্রমান দেয় | সামনে লাল আলোর সিগন্যাল | তাই চুপটি করে চার পায়ে দাঁড়িয়ে অজস্র গাড়ির ভিড় | অজস্র মানুষের ঢল ওই রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত এখন | ৫ দিন ঘর্মাক্ত অফিস এর পরও, বাঙালি আজ আর ঘুমোতে চায়না | চির আলস্য কাটিয়ে আজ তারা রাস্তায় নেমেছে পুজোর শপিং এ | কেউ গড়িয়া, কেউ শ্যামবাজার যে যার পছন্দের জায়গায় কেনাকাটা করতে ব্যস্ত | পুজো এগিয়ে আসছে যে দ্রুত | তা শুধু বাঙালির চিন্তনে নয়, কুমোরটুলির শিল্পীর হাতের গতি লক্ষ করলেও বোঝা সম্ভব |
আর কদিন পরেই মহালয়ার সকালে ঘোষিত হবে দেবীপক্ষের শুভারম্ভ | সবাই আরো উদ্বেলিত হয়ে অপেক্ষার দিন গুনবে | টেলিভিশন স্ক্রিন এ মুখ ঢুকিয়ে দেবে, মহিষাসুর বধ দেখার আসায় | আমার ও ছোটবেলা এরকম ই ছিল | এরকম একটা অপেক্ষা ও ছিল | ভোর রাতে রেডিওর সেট টা খুলে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলার আওয়াজ এর অপেক্ষায় রইতাম | এই তো শুরু হবে - "আশ্বিনের শারদপ্রাতে জেগে উঠেছে আলোকমঞ্জীর....." | মহিষাসুর মর্দিনীর এই কাহিনী কতদিন ধরে চলে আসছে, রেডিওর সাথে সাথে, ওনার কণ্ঠ ধরে | সেই কণ্ঠ যেন আজ ভাসে কানের মধ্যে | অথচ কী নিষ্ঠুর ভাবে একদিন, তাকে না জানিয়েই মহালয়ার 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুরু হলো উত্তম কুমার কে দিয়ে | ১৯৭৬ সালের সেই দিনের পরিবর্তিত স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন তৎকালীন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় | অথচ অনুষ্ঠান একেবারে ফ্লপ | জানিয়ে করলে হয়তো , উনি এব্যাপারে উৎসাহই দিতেন | উত্তম কুমার অবশ্য তার কাছে আগেই থেকেই নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলেন | বড়ো মনের পরিচয় দিয়ে তিনি বাঙালির মহানায়ক কে আস্বস্ত করে,আরো উৎসাহিত করে তোলেন | কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও বাঙালির মহালয়ার আবেগের মধ্যে ঢুকতে পারেননি মহানায়ক |
এরপর ই ঠিক হয়, ষষ্ঠীর দিনে তিনি 'মহিষাসুরমর্দিনী' আবার পাঠ করবেন | মহিষাসুরমর্দিনী এবং তার বেতারকণ্ঠ বোধহয় অবিচ্ছেদ্য, চিরকালীন | যতই দুঃখ পেয়ে থাকুন না কেন, তিনি আবার নতুন উদ্দমে নেমে পড়েন নিজের কাজে | রেকর্ডিং করে প্রোগ্রাম শোনানোর রীতি ছিল না তখন রেডিও তে | সব প্রোগ্রাম ই লাইভ হতো | সুর করে সংস্কৃত শ্লোকের মতো করে পড়ার রীতি তখন ও শুরু করেননি তিনি | রেকর্ডিং রুম এ ছিলেন বাণীকুমার | হটাৎ ই বাংলার মতো করে পড়তে পড়তে, তিনি সংস্কৃত স্তোত্র পাঠের মতো করে পড়তে শুরু করেন মজার ছলে | কিন্তু বাণীকুমার বেরিয়ে এসে বলেন, ভালো লাগছে | এইভাবেই চলুক | তিনি আবার একই ভাবে শুরু করলেন “দেবী প্রসন্ন হলেন...।” তারপর তো পুরোটাই ইতিহাস | আজও শুনে আসছি সেই একই সুরে ওনার 'মহিষাসুরমর্দিনী', প্রতি মহালয়ার অতি ভোরে |
১৯২৭ সালে কলকাতার গার্স্টিন প্লেস এ শুরু হয় অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র | কিন্তু এই কেন্দ্র কে তো ফুলে ফলে সুসজ্জিত করেছিলেন তিনি ই | তিনি তো শুধুই চন্ডীপাঠ করেই বিখ্যাত হননি | তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, নাট্যকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, অভিনেতা, ব্রডকাস্টার | রেডিওর নাটক কে তিনি এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কলকাতা যখন তার ব্যক্তিসত্তা হারিয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তিম পর্বে এসে কলকাতা যখন তার প্রাণ হারিয়েছে, তখন ই তিনি 'বিরূপাক্ষ' ছদ্দনাম নিয়ে এক ব্যাঙ্গরসের আসর বসান | প্রতি রবিবার দুপুর ১টায় এই অনুষ্ঠান পরিবেশন করতেন যার নাম 'বিরূপাক্ষের আসর' | এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় প্রথম ও দ্বিতীয় কোনো আর্টিস্ট ই উপস্থিত নেই | সেই অবস্থাতেও প্রোগ্রাম বন্ধ হতে দেননি | প্রথমে পিয়ানো বাজিয়ে আর তারপর রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান | কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর শোকযাত্রাও ধারাবিবরণী দিয়ে শোনান বেতার জগৎ এর মাধ্যমে | বহু শ্রোতা ওই ধারাবিবরণী শুনে অশ্রুস্নাত হয়েছিলেন | একাত্ম হয়েছিলেন কবিগুরুর ভাবনার সঙ্গে |
অথচ এহেন ব্যক্তিত্বের ভাগ্যে কী জুটলো ? স্টাফ আর্টিস্ট হয়েই অবসর গ্রহণ করলেন, তাই পেনশন ও জুটলো না | জীবনের শেষ বেলায় এসে শুধু একরাশ অভিমান বুকে নিয়েই থেকে গেছেন | সংসার চালানোর জন্য এদিক ওদিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে গিয়েছেন | শেষকালে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ায়, আকাশবাণীর শেষ অনুষ্ঠান থেকেও তাকে বেরিয়ে যেতে হয় | এভাবেই একরাশ বেদনা নিয়ে ১৯৯১ সালে তিনি বিদায় জানালেন এই পৃথিবী কে |
দেবী দূর্গা কে তো বাঙালিরা মাতৃত্বের অন্যরূপ হিসাবে দেখতেই বেশি অভ্যস্থ | মা কে যেভাবেই ডাকি না কেন উনি আসবেন | তবুও যেন, ওনার ডাকার মধ্যে আলাদা এক মাধুর্য অনুভব করা যেত | ফিরে আসেন তিনি বারবার মহালয়ার পুন্য তিথিতে | ভোরবেলায় বাবা ডেকে দিতেন ওই মহালয়া শোনবার জন্য | টেলিভশন এর প্রোগ্রাম টার জন্য মুখিয়ে থাকতাম, কিন্তু তা অনেক পরে শুরু হতো | হালকা শুয়ে, ঘুমিয়ে কিছুটা কানের মধ্যে আসতো বারবার | রেডিওর বেশির ভাগ পর্বই যেন অবুঝ হয়ে থাকতো আমার মনে | কিন্তু কেন জানিনা আজও ওই আওয়াজ ভোলবার নয়, এখনো তাই প্রতি বছর অভ্যাস বশতই মহালয়ার দিন কাকভোরে রেডিও খুলে বসি | ছোটবেলায় না বুঝলেও এখন যেন একটা আবেগতাড়িত টান অনুভব করি রেডিওর প্রতি | তিনি তো শুধু এক প্রজন্ম নয়, বহু প্রজন্মের জন্য দেবী বন্দনা করেছেন | তার আওয়াজ এই তো বাঙালির পুজোর আগমন বার্তা শুরু হয় | হয়তো আগামী প্রজন্ম ভুলে যাবে তার দান, রেডিও তে সোনা হবে না "যা দেবী সর্বভূতেষু ....", তাও তিনি ইতিহাসের পাতায় এক অবিশ্বরণীয় চরিত্র হিসাবেই বেঁচে থাকবেন |​
আভিজাত্যের মোড়কে আবার আমার শহর ব্যস্ত হয়ে উঠেছে | হাজার হাজার কার্বন কণিকার ধোঁয়া উড়িয়ে সবাই আজ উন্নতির ধ্বজা তুলে ধরতে আগ্রহী | এর মধ্যেও কোনো তারাপদ জ্যাঠা হয়তো খাটের তলা থেকে ধুলো ঝেড়ে বের করে আনবে তার অযত্নের সঙ্গী রেডিও টাকে | মহালয়ার কাকভোরে আবার হয়তো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নেমে আসবেন তারাপদ জ্যাঠার বাড়ি | চন্ডীপাঠ করে যাবেন সুরে সুরে, সেই আগের মতো | পুজোর আগমনী বার্তা দিয়ে যাবেন সবার কানে কানে | কদিন পরেই তো আবার পুজো ! জিলিপির দোকানে ভিড় করবে খুদে বন্ধুরা, ম্যাডোক্সে পেপার পেতে বসে আড্ডার পসরা সাজাবে, হাজারো অচেনা বন্ধু, শত সহস্র পায়ের তালে তালে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মানুষের ঢল নামবে | আবার তিনি হারিয়ে যাবেন আরেকটি বছরের জন্য !

0 comments:

Post a Comment