Thursday 23 April 2020

একটা বেজন্মা পঙ্কোজ A sterile Pankaj

0



হাওড়া থেকে বর্ধমান মেন লাইনের ট্রেন ছিল আমার আর আমার বরের(তখন বয় ফ্রেন্ড) কলেজ পালিয়ে টাইম কাটানোর অন্যতম প্রিয় জায়গা।দুপুরের দিকে কলেজ থেকে ক্লাস পালিয়ে বেড়িয়ে একটা বর্ধমান লোকালে উঠে পড়া আর তারপর ট্রেনের তালে চলতে থাকা।শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই নতুন আনন্দে আমাদের এই ট্রেন ভ্রমণ চলতে থাকতো।আপ লাইনে দুপুরের দিকে ট্রেনে খুবই কম লোক থাকতো।বেশীরভাগ দিনই খুব সহজেই আমরা জানালার ধারের সীট পেয়ে যেতাম।তারপর হাজার গল্প, খুনসুটির সাথে সাথে জানলা দিয়ে কত রকমের দৃশ্য দেখতে দেখতে কল্পনা আর বাস্তবের মিলমিশে গড়া এক মায়াবী জগতে চলে যেত আমাদের মন।যারা বর্ধমান লাইনে গেছেন তারা জানবেন যে কয়েক বছর আগেও(এখন জানিনা) মেমারীর পর থেকে বর্ধমানমুখী স্টেশনগুলো একপ্রকার সহজ সরল গ্রাম্য স্টেশনই ছিল।ট্রেন থেকে কখনও বা স্টেশনের পাশের হলুদ সমারোহ সরষে ক্ষেত, কখনও বা সারি সারি কাশফুল দেখে অজানা স্টেশনে নেমে পড়তাম আমরা।তারপর কিছুক্ষণ স্টেশনের কাছাকাছি মাটির রাস্তা ধরে ঘুরে, অচেনা লোকের সর্ষে ক্ষেতে DDLG র pose দিয়ে ফটো তুলে, বা ঝিলের ধারে গাছের সুনিবিড় ছায়াতলে মাছ ধরতে বসা কাকুর সাথে আগডুম বাগডুম গল্প করে, সারি সারি গাছের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া খেয়ে,বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকে আবার ফেরার ডাউন বর্ধমান লোকাল ধরতাম।কখনও বা মধ্য গগনের সূয্যিমামার দীপ্ত ছোঁয়ার ভয়ে ট্রেন থেকে নামতাম না।ঝালমুড়ি,ছোলা সেদ্ধ,বাদাম,সোন্ পাপড়ি, দিলখুশ,কাঁচা আম,কুলফি যা যা উঠতো সব খেতে থাকতাম।তা সে যাই হোক আজকের গল্পের বিষয় অন্য কিছু।এবার তার কথায় আসা যাক।
এরকমই একদিন গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে সম্ভবত বৈঁচী স্টেশন থেকে একটা ৯-১০ বছরের ছেলে মা র সাথে ওঠে।খালি গা, হাফ প্যান্ট পরা, মাথায় রুক্ষ চুল, কষ্টি পাথরের মতো কালো গায়ের রঙ আর তাতে অসম্ভব মিষ্টি মুখখানা আর টানা দুটো চোখ।একেবারে কৃষ্ণ ঠাকুর।মার হাতে বিশাল এক বস্তা।বস্তা নিয়ে মা বসলো দরজার ধারে।বাচ্চাটি আমাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের দুজনকে দেখতে লাগল আর মিচকি মিচকি হাসতে লাগলো।আমার ভীষণ কৌতূহল হল।
“আমি তো ইংরাজী জানি।ক্লাস ফাইভে পড়ি।স্কুলেও শেখায়।আর একটা কাকুর কাছে পড়তে যাই।১০০ টাকা নেয়।এখন দুপুরে মা আর খায় না।তাই তো মাইনে দেবার টাকা আসে।আমি অনেককিছু জানি ইংরাজীতে।ট্রেনে ওঠার আগে দেখলাম সূর্য মাথার ওপর থেকে সরে গেছে।তার মানে ১২টা বেজে গেছে।১২টা বেজে গেলে Good afternoon হয় আর ১২টার আগে Good morning. Good afternoon দিদি।Good afternoon দাদা।শুধু তুমি কি একটা বললে ইংরেজীতে ওটার মানে জানি না।ওটার মানে কি গো?আরএকবার বলো না।”
ওদের দুজনকে খাওয়াবার খুব ইচ্ছা করছিল।কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য সেদিন কিছুই ওঠেনি ট্রেনে।হয়তো বেশী পেছনের দিকের কামরায় ওঠা হয়ে গেছে।ব্যাগেও একটা বিস্কুটও নেই।পার্স থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করে “এই নে তোর প্রাইজ।বড়ো মানুষ হতে গেলে তো আরও বেশী করে পড়তে হবে।এটা তোর সামনের মাসের মাইনে।কদিন কাগজ না কুড়িয়ে ওই সময় পড়বি।”
“এইটা তোমার হাতে ফোন তাই না দিদি? এতে আমার আর মায়ের একটা ছবি তুলে দেবে?তুলে তোমার কাছে রেখে দাও।আমি বড়ো হলে তোমার কাছ থেকে গিয়ে নিয়ে আসবো।তোমার ফোন নাম্বারটা খাতায় লিখে দিও।ছবি তোলার পর আবার দিচ্ছি খাতাটা।আর দুটো লজেন্স দেবে?একটা মার একটা আমার।বাড়ীতে বোন আছে কিন্তু ওর তো এখনও দাঁতই বেড়োয়নি।ওকে আমি পরে কিনে দেব।আর কেউ নেই বাড়ীতে।”
ট্রেনটা তখন কোন একটা স্টেশনে থেমেছিল।প্রায় ছাড়ার মুখে।হঠাৎ এক চেকার উঠে ওদের দিকে রে রে করে তেড়ে এল “এই তোরা আবার উঠেছিস!!!Ticket কাটার মুরোদ নেই এদিকে ট্রেনে চাপার শখ ষোলোআনা।যত বেজন্মার দল।আবার আম বিক্রী করছিস।”প্রায় ইলেকট্রিক শক লেগে রিঅ্যাকশানের মতো মা ছেলে ছিটকে বেড়িয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।আমরা পেছন পেছন দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে “যাস না।আমরা ভাড়া দিয়ে দেবো।চকোলেট টা নিয়ে যা।ফোন নাম্বার নিলি না তো।”ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গতি নিয়ে নিয়েছে।নামার সাহস আমাদের নেই।পরের স্টেশনে নেমে নেক্সট্ ট্রেনে আবার ব্যাক করেছিলাম।না কুমুদের দেখা আর পাইনি।তারপরেও অনেকদিন ওই লাইনে গেছি কিন্তু কোনোদিনও পাইনি।

0 comments:

Post a Comment