Saturday, 18 April 2020

বৃষ্টি ভেজা আতঙ্ক The rain is wet panic Bengali Story from iLvStories

0

এই রে! এতক্ষন ধরে বকবক করে চলেছি অথচ পাঠককূলকে আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয় নি। আমি হলাম শান্তিপ্রিয়া। না না, 'ওম শান্তি ওম' ছবির দীপিকা পাড়ুকোণ ভেবে বসবেন না যেন। আমি হলাম পায়রাডাঙার পুকুর আর ধানক্ষেতের মধ্যে বেড়ে ওঠা শান্তিপ্রিয়া প্রামাণিক।নাম শুনে আবার মনে করছেন হয়তো চোখে চশমা আঁটা তাঁতের শাড়ী পড়া বছর পঞ্চাশের কোনো বদরাগী মহিলা আমি। এই যেমন কানা ছেলের নামও পদ্মলোচন হয় তেমন আর কি। এবারেও কিন্তু ভুল ভাবছেন। আমি ৩০ ছুঁইনি এখনো। নামটা দাদার রাখা, লেখক শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়ের অনুকরণে। তা আমার মধ্যেও কিছুটা ভাব প্রকাশ পেয়েছে আর কি। নামের মহিমা বলেও তো কিছু আছে। আমি আজকাল 'চিন্তক' ছদ্মনামে একটু আধটু রোমহর্ষক উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। মিথ্যে বলবো না; কাটতিও হচ্ছে বেশ।
আমাদের ক্যাবটি আপাতত বিশাল বড়সড় ট্রাফিকে আটকে।বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরেই চলেছে আর তার সাথে মাঝে মাঝে চলছে দমকা হওয়ার খেলা।ক্যাবের ভিতরের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে হঠাৎ জ্ঞানমণি বাবু গুনগুন করে উঠলেন, 'রিমঝিম গিরে সাওন'। ওনার যা সুরের বহর কিশোর কুমার বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করে বসতেন।"জানেন স্কুলে থাকতে গানের কম্পিটিশনে এই গানটা গেয়ে আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম। সবাই বলতো একেবারে যেন স্বয়ং কিশোর কুমার"। খক্ খক্ খক্!!! ওনার ৫০০% মিথ্যে কথা শুনে আমার বেমক্কা এমন জোর হাসি পেয়ে গেল যে সেটা চাপতে গিয়ে কেশে কেশে প্রায় যায় যায় অবস্থা। মানতে হবে ড্রাইভার বাবাজি আজ অদ্ভত সংযমের পরিচয় দিচ্ছেন। ইশ! টেলিপ্যাথিটা ঠিকঠাক জানা থাকলে কি ভালোই না হতো, একটু টিপ্স নিতাম।
লেখালেখির পাশাপাশি আমি ধর্মতলায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে চাকরী করছি এই সবে দু’বছর হল। ঠাকুরপুকুরে মাসীর বাড়ীতে থেকে যাতায়াত করি,আর সপ্তাহান্তটা তোলা থাকে পায়রাডাঙার জন্য। এখন লালবাজার থেকে ফিরছি।না পুলিশদের নিয়ে আমার পরবর্তী উপন্যাস লেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আসলে গেছিলাম লালবাজার থানার উল্টোদিকে ধ্রব টি সেন্টারে। ওখান থেকে দার্জিলিং টি কিনলাম। ফ্যানিংস ছাড়া আমার ঠিক পোষায় না। তাই বাইরে কোথাও চা খাই না। এই চা খাওয়া থেকে একটা অদ্ভত কথা মনে পড়ল। দিন দুয়েক আগে একজন হিন্দিভাষী ভদ্রলোকের সাথে কথা হচ্ছিল। উনি তো চা খাবেন কি না জানতে চাওয়ায় হেসেই কুটোপাটি।জিজ্ঞাসা করলেন আমরা বাঙালিরা চা 'খাই ' কি করে? ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে শুদ্ধ বাংলায় তরল জিনিস পান করা হয় কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কিছু শর্ট করার তাগিদে আমরা এখন সবই খাই।এই অবস্থার সম্মুখীন হয়তো সব বাঙালিকেই কখনো না কখনো হতে হয়েছে।

"জানবাজার চেনেন?ওখানে একটা দোকানে ফটোফ্রেম করতে দেওয়া ছিল। নিতে গিয়ে দেখি উল্টোদিকেই একটা সাইনবোর্ডে লেখা 'রাণী রাসমণির বাড়ি '। বাড়িটা দেখে মনটা কেমন করে উঠল। আপনি দেখেন সিরিয়ালটা? ভালো হচ্ছে কিন্তু। মেয়েটা কি ভালো অভিনয় করে তাই না?"- খুবই আনন্দের সাথে কথাগুলো বললেন জ্ঞানমণিবাবু।"হবে হয়তো, আমি এখনকার বাংলা সিরিয়াল দেখি না”।ওনার হাসিখুশি ভাবটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। ভদ্রলোককে এখন বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। আমাদের ক্যাব এতক্ষনে খিদিরপুর ঢুকব ঢুকব করছে। "আচ্ছা অপরাধ সম্পর্কে আপনার কি মতামত? মানে অপরাধ ঠিক কত ধরনের হতে পারে?এই যেমন শুধু মানসিক বা শারীরিক নয়, আমি বলতে চাইছি আরো কিছু !" এমন অতর্কিত আক্রমণ আমি আমার দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি। এ আবার কি ধরণের প্রশ্ন? লোকটা ঠিক কি চায়? আমি লোকটার মুখের দিকে না তাকিয়েও ঠিক বুঝতে পারছি ওনার চোখটা হয়তো অস্বাভাবিক রকম চকচক করছে।
"আমার এই বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান নেই।"- কথাগুলো খুব ধীরে ধীরে বললাম। "জানতে তো হবেই। অপরাধ তো আকছার হচ্ছে চারিদিকে; আপনার আমার আশেপাশে। কখনো হয়তো আমাদের সাথেই হয়ে গেল কিংবা আমরাই অপরাধী হয়ে গেলাম"। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। "হমম, তা হলিউডের সিনেমাও কি দেখেন না? একটু আধটু হলেও খোঁজ রাখেন আশা করি। কুয়েন্তিন তারান্টিনোর নাম শুনেছেন? কি অসাধারণ সব সিনেমা বানান উনি। আহ্! একেবারে রত্ন। আমার তো..." মিঃ চৌধুরীকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে আমি বলে উঠলাম, "না ঐরকম নৃশংসতা আমি দেখতে পারি না। সে বাস্তবে হোক কি সিনেমার পর্দায়"। উনি ওনার মুখটা আমার কানের অনেকটা কাছে নিয়ে এসে বললেন, "কিন্তু আমার তো ভালো লাগে। রক্ত!" আর এরপরই তীব্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এই রহস্যময় লোকটা প্রত্যেক সেকেন্ডে আগের থেকেও বেশি করে রহস্যময় হয়ে উঠছেন। একটা অজানা আতঙ্ক যেন হঠাৎ আমায় গ্রাস করে বসলো। আর উনি সেই বাঁজখাই গলায় গাইতে শুরু করে দিলেন 'নায়ক নেহি খলনায়ক হু ম্যাঁ'।
উনি এই মুহূর্তে কোন কুমার তা আর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনারা সকলে নিশ্চয় ভালো করেই জানেন এবং মানেন যে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দরকারের সময় তিনটে জিনিস পাওয়া যায় না - বাস, সিনেমার পুলিশ আর ফোনের টাওয়ার। তা আমাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আমার ফোনটি আপাতত অচলাবস্থায় বিরাজমান। মানে আমি এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আর কতক্ষন যে এভাবে চলবে? এই সিরিয়াস সময়ে একটা খুব প্রিয় গান হঠাৎ মনে পড়ে গেল -'এই পথ যদি না শেষ হয়'। লিস্টটা একটু বদলাতে হবে এবার।এই গানটা এই মুহূর্তে আমার কাছে ভীতিপ্রদ।গুপী-বাঘার জুতোজোড়াটা দারুন মিস্ করছিl থাকলে এখন কাজে লাগানো যেতl ভূতের রাজা আপনি কোথায়?

"ও ড্রাইভার দাদা একটু জোরে চালান না। এখন তো রাস্তা আগের তুলনায় অনেকটাই ফাঁকা। পিছনের গাড়িগুলো তো সব পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। "ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি।"আহা! এতো রাগছেন কেন? বেশি রাগলে ব্লাড প্রেসার বেড়ে গিয়ে শরীর খারাপ করবে তো।" লোকটার কি বাড়ি পোঁছানোর আদৌ কোনো তাড়া নেই? যতদূর মনে পড়ছে আমার গন্তব্যটাই আগে ছিল।

দেখতে দেখতে বেহালা চৌরাস্তা চলে এল। ঘড়ির কাঁটা রাত ১০ টা ছুঁয়েছে। বৃষ্টি পড়া অনেকক্ষন আগেই বন্ধ হয়ে গেলেও চারদিকটা কেমন যেন থমথমে। চৌধুরী মশাই জানলার দিকে কাত হয়ে বসে ঠিক কি করছেন বোঝা যাচ্ছে না। এদিকটায় মনে হয় ঝড়ের দাপট একটু বেশীই ছিল। রাস্তায় অনেক জায়গায় গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে। স্ট্রীটলাইটগুলো বেশিরভাগই অকেজো; ভরসা বলতে গাড়ির হেডলাইটগুলোই। "তা মামণি এযাত্রা বাড়ি তো আর স্বজ্ঞানে পৌঁছানো গেল না!" বলেই জ্ঞানমণিবাবু হঠাৎ আমার নাকে একটা রুমাল চাপা দিয়ে দিলেন। গন্ধটা একটু মিষ্টি মিষ্টি। স্কুলে থাকতে কি যেন পড়েছিলাম ? ক্লোরোফর্ম ? আমার আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি মাসির ঘরে বিছানায় শোয়া। মাসি হাতে একটা জলের গ্লাস নিয়ে আমার পাশে বসে মাথায় জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।"উফ্! তোর জ্ঞান ফিরল।আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। জানিস তো তোর মেসোও বাড়ীতে নেই ,তাতানকে আনতে গেছে।" আমি মনে করার চেষ্টা করলাম ঠিক কি হয়েছিল কিন্তু পারলাম না। মাসি বলে চলল,"ড্রাইভার আর আরেকটা লোক মিলে তোকে পাঁজাকোল করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া নিয়ে এই যে তোর এত নাক সিঁটকানো আর চলবে না বলে রাখলাম। ওরা ভাল মানুষ বলে তোকে সাবধানে নিয়ে এলো, না হলে জানিসই তো আজকাল রাস্তাঘাটের অবস্থা। ভগবান না করুন কাল তোর কিছু হলে দিদিকে কি জবাব দেব বল দেখি। অনেক রাত হয়ে গেল। যাই তোর খাবারটা নিয়ে আসি।" চেয়ে দেখি আমার হ্যান্ডব্যাগের কোণা থেকে একটা সাদ কাগজ উঁকি দিচ্ছে। হ্যা আমাকেই লেখা একটা চিঠি।প্রথমেই নিজের ব্যবহারের জন্য আমি আপনার কাছে অত্যন্ত ক্ষমাপ্রার্থী। আপনার কোনোরকম ক্ষতিসাধন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি আদতে একজন মেডিক্যালের ছাত্র। হ্যা এটাই সত্যি,আমি মেকআপ করে ছিলাম।অভিনয় আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা শখের পর্যায়ে পরে আর আমি মাঝেসাজে একটু আধটু থিয়েটারও করি। মাকে চমকে দেওয়ার জন্য না তোলা মেকআপটা আজ যে এভাবে কাজে লেগে যাবে তখন বুঝিনি।
আপনার হয়তো খুব রাগ হচ্ছে; পুলিশে যাওয়ার কথা ভাবছেন;ঠিক আছে যান কিন্তু তার আগে আমার বক্তব্যটা জেনে রাখুন।অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি একটা সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিল্লারকে নিয়ে সিনেমা বানাতে। কিন্তু বিভিন্ন কারনে তা হয়ে উঠছে না। কিন্তু সিনেমা তো আমায় বানাতেই হবে আর তাই ঠিক করেছি এইভাবেই রিয়েল লোকেশনে রিয়েল টাইমে মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে শুট করব। আপনাকে দিয়েই আজ শুরু করলাম শান্তিপ্রিয়া। আপনি যখন ফেসবুকে মশগুল ছিলেন তখনই আমি গাড়ীতে কয়েকটা ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন ফিট করে দি। আপনার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে মেসেজ করে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে ড্রাইভারকেও হাত করি। ক্লোরোফর্মের প্রয়োগ খুব স্বল্পমাত্রায় করা যাতে আমার কাজও হয়ে যায় আর আপনার জ্ঞানও ফেরে তাড়াতাড়ি। আপনার ব্যাগ ঘাঁটতে গিয়ে আপনার পরের গল্পের পাণ্ডলীপিটা পেলাম।ভালো লাগলো পড়ে। যেমন লেখা আপনার প্যাশন তেমনি সিনেমা আমার।তাই হয়তো ঝুঁকি নিতে পারলাম। আশা করি আপনি বুঝবেন।ফ্যানিংসের পরিমাণটা একটু কম করে দিলাম;রাগবেন না যেন। ও হ্যা বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম কিন্তু জ্ঞানমণি নয়,ওটা অন্য একজন বুক করে দিয়েছিল।ভাল থাকবেন। শুভরাত্রি।'
না আর পুলিশে যাই নি। দুইদিন পরে কেউ এসে বারান্দা দিয়ে একটা খাম ছুঁড়ে চলে গেছিলো। পেনড্রাইভটা চালিয়ে দেখি সেই রাতের ভিডিও যেখানে অজ্ঞানরত অবস্থায় আমার দেহ ক্রমাগত ছুরিকাঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে;আর ড্রাইভারও মৃতাবস্থায়।একটা চিরকুটও সাথে ছিল অবশ্য, যাতে লেখা ‘চিন্তক চাইলে ওই রাতের বিবরণী দিতেই পারে; আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আসল পরিচয়টা আপাতত উহ্য রইল পরে সিনেমা হলে গিয়ে না হয় জেনে নেবেন।‘ আমার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি খেলে গেল।

0 comments:

Post a Comment